বিজয়ের উল্লাস

প্রকাশিত: ৪:১০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০

বিজয়ের উল্লাস

বিনতা দেবীঃ
শহরের এক প্রান্ত থেকে সতেজ কন্ঠে হাঁক দিলে কন্ঠ ধব্বনি ওদের বাড়ীর ওয়ালে ধাক্কা না খেয়েই সবার কর্ণগোচর হবে হয়ত।
রহিমা খালার স্বচক্ষে দ্যাখা ঘটনা ঘটে গিয়েছিল
একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ এর প্রভাতে। ওদের
পাশের বাড়ীর আঙ্গিনায় ও নিজ বাড়ীর ফুলবাগানের
দক্ষিণ পাশটায়। শিরিষের ছায়।
রহিমা খালা ফজরের নামাজ আদায় করে। পশ্চিম ব্যালকনির লাইট এর সুইচ টা বন্ধ করেন এটা উনার নিত্যদিনের অভ্যাস।দরজাটা খুলতেই উনার চোখে পড়ল
ব্যালকনির নীল অপরাজিতা গাছটা কেমন জানি নেতিয়ে যাচ্ছে, দেখেই উনার ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল!কোন অমঙ্গল পূর্বাভাস নয়তো। মুহূর্তে র মধ্যেই উনি একটা বিকট শব্দ শুনতে পান।
চোখ ফিরাতে না ফিরাতে চোখে পড়ে একই দেওয়ালের সীমানায় পাশের বাড়ীর #কৃষ্ণকান্ত দাদা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে কাতরাতচ্ছেন। ছেলে নীলকান্ত ওয়াল ডিঙ্গিয়ে আমার বাসার ফুল বাগানে পড়ে, কিন্তু তাতে
রক্ষা পেলনা সে। নীলকান্তকে হানাদাররা ধাওয়া করে গুলি ছুড়ে সে ক্ষত বিক্ষত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল এই ফুল বাগানের শিরিষ গাছটার নীচে।
যে কিনা রহিমা খালাকে ছোট মা বলে ডাকত।উনি নীলকান্তকে খুব আদর করতেন একেবারে নিজের সন্তানের মতো। ছোট বেলা ওকে তিনি কতো কোলে পিঠে নিয়েছেন। রহিমা খালা নিঃসন্তান ছিলেন।তিনি
সন্তানের আনন্দ নীলকান্তের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন।
তিনি বাড়ীর দালানের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম দিকের রুমটায় থাকতেন।
কিছুক্ষণ পর হায়েনা-দারদের অনুপস্থিতি অনুভব করলে।বাসার সবাইকে ডেকে তুলে এক ঘটি দুধ নিয়ে তাড়াতাড়ি করে, বাবা নীলকান্ত নীলকান্ত বলে চিৎকার করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে নীলকান্ত কে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন আর প্রলাপ করতে থাকেন বাবা দেখ তোর জন্য দুধ নিয়ে এসেছি তুই না দুধ ভাল বাসিস বলে ওর মুখে দুধ দেন। কে দুধ খাবে, নীলকান্ত ততক্ষণে ইহলোকে আর নেই।নির্থর দেহ পড়ে আছে ফুল বাগানের দক্ষিণ পাশটায় শিরিষ গাছটার নীচে।ফুল বাগানের ফুলেরা রক্তে স্নাত হয়ে নীলকাম্তকে অভিবাদন জানালো। রহিমা খালা বিলাপ করতে থাকেন,
মাত্র কটা দিন হল এই তো ফাগুনের শেষান্তে নীলকান্তের
বিয়ে হলো। অধিবাসের দিন
সে চওড়া পাড়ের ধূতী হলুদ পাঞ্জাবী পরে সন্ধ্যার পর পরই এসে বলল ছোট মা, ছোট মা, মা বলছেন, তোমাকে সালাম করে
যেতে তাই এলাম গো তোমার আশির্বাদ মাথায় পুরে নিতে, এক্ষুনি বাসায় চলে এসো।
চাচ্চুকে বরযাত্রী যেতে হবে কিন্তু।
ছটা মাস ও হলো না বৌটা স্বামী হারা হলো। আমি পাতাইননা মা সইতে পারছিনা, ওর মা তো
এখনো দেখেনি তার প্রিয় পুত্রের একরুণ দৃশ্য কি করে সইবে এ পুত্র শোক!!!!!
এদিকে নীলকান্তের মা স্বামীর মৃত দেহ নিয়ে বিষাদে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন, আর ভাবছেন যাক ছেলেটা পালিয়ে গিয়ে ভালই করেছে। না-হয় আজ ওকে ও
প্রাণ বিসর্জন দিতে হত।
মা’কে কেউ কোন ভাবেই জানতে দেননী, যে তার নীলকান্ত বেঁচে নেই। কচি বৌটা দুঃখে পাষাণ হয়ে নীরবে
এক সময় বাবার হাত ধরে চলে যায়, বাবার বাড়ীতে।
“বিধি লিখেছিল তার ভালে
এই ছিলো তার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কপোলে”
দীর্ঘ নয়টি মাস নীলকান্তের “মা”হেমালীনির চোখেরজল স্রোতস্বিনী গঙ্গার মত দু নয়ন বেয়ে কতো গড়িয়ে পড়ছে……..
এভাবে,মা পথ চেয়ে আশায় আশায় বুক বেধে বেঁচেই ছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে তাঁর নীলকান্ত আসবে, বুকে জড়িয়ে বাবাকে হারানোর
ব্যাথা কিছু টা হলেও মায়ে’র পরশে ম্লান হবে। ছেলে
শশুড়ালয় থেকে বৌ মাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।আবার তার গৃহাঙ্গন লক্ষীর পদ ছায়ায় আড়ম্বরপূর্ণ
হয়ে উঠবে।
বিজয় অর্জিত হলো
জাতি নিদিষ্ট ভূখণ্ড পেল
পেল নতুন মানচিত্র ও নতুন পতাকা
সগৌরবে মাথা উঁচু করে বাঙ্গালী দাঁড়ালো আপন সত্তায়।
মা,
হেমালীনির প্রতিক্ষার প্রহরী রা তন্দ্রায়িত হলো
চোখের জল ফুরিয়ে দৃষ্টি স্তব্দ হলো।
স্বামী হারা হেমালীনি পাগলের মতো তাঁর একমাত্র ছেলেকে
খুঁজে না পেয়ে যখন বুঝতে পারলেন, নীলকান্ত আর
ফিরবে না তিনি দুঃখে বেদনায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে
পাগলের মত প্রলাপ করতে থাকেন?
কিসের স্বাধীনতা?? স্বাধীনতা?? স্বাধীনতা…………
যে স্বাধীনতা আমায় নিঃস্ব করে দিয়েছে, আমার স্বামী সন্তান বিয়োগ করে দিয়েছে , আমার পুত্রবধূ গৃহের পর হলো তার কাছে স্বাধীনতা যে কত মর্মস্পর্শী একমাত্র ভোগী ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না…………
কি আনন্দ!!আনন্দের জয়ধ্বনি! উড়ছে বিজয় নিশান !!!! বিজয়ের জয়গান চারদিকে আনন্দ উল্লাসের ঢেউ বাতাসের গায়ে বিজয়ের জয়ধ্বনি প্লাবিত । উল্লসিত জনতার ভীড়ে স্বজন হারানোর ব্যাথা নিয়ে ” মা হেমালীনি” হৃদয় পোড়ানো দগ্ধ ব্যাথায় চোখ বুজে তাঁর উপন্যাসের পাতা উল্টাতে থাকেন…….

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

shares