বিমান বন্দরে “প্রবাসী যাত্রী নিরাপত্তা সেল” গঠন করা হোক

প্রকাশিত: ১:০৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৮, ২০২১

বিমান বন্দরে “প্রবাসী যাত্রী নিরাপত্তা সেল” গঠন করা হোক

দেওয়ান ফয়সাল//

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর যেন দুর্বৃত্তদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বিমান বন্দরের অবস্থাদৃষ্টে এবং প্রবাসীদের অভিযোগ থেকে বুঝা যায় যে, সিলেট বিমান বন্দরে দায়িত্বরত কোন ম্যানেজার নেই। আর যদি থেকেও থাকেন তাহলে বলবো কর্মরত অফিসাররা ম্যানজারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের দুর্বৃত্তায়নের কাজ তারা করে যাচ্ছে অথবা ম্যানজারের ইঙ্গিতেই এসব ঘটনা ঘটছে। কারণ একজন বিমান বন্দর ম্যানেজার তিনি যে কোন বিমান বন্দরেরই হোন না কেন ,বিমান বন্দরের রক্ষণাবেক্ষন থেকে শুরু করে যাত্রীদের ভাল সেবাদানের ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখা তার দায়িত্ব। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে প্রবাসীদের প্রতি সম্প্রতি যে সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, এগুলো যেন তিনি পরোয়াই করছেন না। সিলেটবাসীর মধ্যে জল্পনা কল্পনা চলছে, সরকারের কোন শক্তিধর ব্যক্তির সাথে হয়তো তার দহরম মহরম বেশি তাই কেউ কিছু বলছেনা অথবা সেই শক্তিধর ব্যক্তিও দুর্বৃত্তদের আয়ের অংশীদার।

গত ২৮শে জুলাই সিলেট থেকে লন্ডন সরাসরি ফ্লাইটে বাংলাদেশ বিমানের বিজি- ২০১ এর যাত্রী ছিলেন জামিলা চৌধুরী। তার স্বামী ছেলে মেয়েদের লন্ডনে রেখে তিনি দেশে গিয়েছিলেন তার অসুস্থ বাবাকে দেখতে এবং ইতিমধ্যে তার ভাইও মারা যান। জামিলা চৌধুরীর বলেন, “দেশ থেকে লন্ডনে ফেরার সময় সিলেট বিমান বন্দরে যখন কর্মরত ইমিগ্রেশনের লোকেরা আমার লকেটর ফরম চেক করে তখন তারা আমাকে বলে, ঐ লকেটর ঠিক না, এটা কাজ করেনা। তখন আমি তাদেরকে বললাম, লকেটর ফরমে যে বারকোড আছে সেটা স্কেন করে নেন তাহলে সবই পেয়ে যাবেন। তারা তা করতে রাজি হয়নি। এ সময় আমার পেছনে প্রায় বেশ কিছু লোক ছিলো তারা আমাকে ধাক্কাধক্কি করতে থাকে। আমি তাদেরকে বললাম, প্লিজ আমাকে আমাকে এসব করবেন না। এরপর তারা আমার সাথে থাকা তিনটি লাগেজ চেক করে লাগেজের ওয়েট বেশি বলে আমাকে ২৬ হাজার টাকা দিতে বলে। আমি বললাম, আমার কাছে ১০ হাজার টাকা আছে ওগুলো নিয়ে যান এর বেশি আমি দিতে পারবোনা। এ কথা বলায় আমার প্রতি উত্তেজিত হয়ে বলে, টাকা না দিলে আপনি যেতে পারবেননা। আমি তখন বললাম, এই লাগেজগুলো আমার নেয়ার দরকার নেই, গেটের বাইরে আমার (নেফিউ) লোক আছে তার কাছে ফেরত দিয়ে দেবো, আমি শুধু হাতের বেগটি নিয়ে নেবো। তারপর বলে ঐ ব্যাগেও মাল বেশি টাকা দিতে হবে নতুবা গেট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আপনি আর যেতে পারবেননা। আমি তখন বললাম, আমি এই ব্যাগটিও নেবো না শুধু আমি এই ফ্লাইটে যেতে চাই, আমার ছোট বাচ্চাটি আমার জন্য কান্নাকাটি করছে সুতরাং আমাকে যেতেই হবে। প্লিজ আমাকে যেতে দিন। লোকটির সোজা কথা আমাকে যেতে দিবে না। আমি বললাম, আপনাদের কি মা বোন নেই? একটু দয়া মায়া নেই? এই অফিসার বললেন, না আমাদের কোন দয়ামায়া নেই। এ সময় তাদের কথা বলতে বলতে আমি ব্যাগ ফোন বের করে রেকর্ডিং করতে থাকি। তারা এটা বুঝে আমাকে সিসিটিভি’র এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়। আসলে তারা আমাকে সম্ভবত: কিডন্যাপ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো বলে অবস্থাদৃষ্টে আমার মনে হয়েছে। এখানে যখন তাদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন চারজন অফিসার সেখানে ছিলো, তারা আমার সামনে আসেনি। তারা দূর থেকে শুধু দেখছিলো। এক প্রশ্নের উত্তরে জামিলা চৌধুরী বলেন, আমি ২২ বছর ধরে বিলেতে বসবাস করছি। আমার মা বাবার পর আমি আর কোনদিন বাংলাদেশে আসবো না, যেখানে বিমান বন্দরে আমার মতো একজন অসহায় মহিলার প্রতি এতো অমানবিক ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে আর আসবো কেন।” ফেইসবুক ডট কম টিভির সাথে এক সাক্ষাৎকারে জামিলা চৌধুরী উপরোক্ত কথাগুলো বলেন।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং টিভিতে এই খবরটি ভাইরাল হওয়ার পর টনক নড়ে বিমান বন্দরের ম্যানেজার সহ সকল অফিসারদের। এখন উপায়ান্ত না দেখে তারা সিলেটস্থ জামিলা চৌধুরীর বাসায় গিয়ে তার সাথে সাক্ষৎ করেন। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের স্টেশন ব্যবস্থাপক চৌধুরী ওমর হায়াত গত ৩১ জুলাই জানান, ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত নাগরিক জামিলা চৌধুরীকে হয়রানীর অভিযোগে দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। তাদের দু’জনকেই সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে তবে এ দু’জনের নাম প্রকাশ করেননি চৌধুরী ওমর হায়াত। নাম প্রকাশ না করার কারণ কি? হতে পারে ওরা জামিলা চৌধুরীর কাছ থেকে টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে নতুবা এই সাময়িক বরখাস্ত লোক দেখানো টালবাহানা।

চৌধুরী ওমর হায়াত বলেন, গত ২৮শে জুলাই ওই নারীর সঙ্গে সৃষ্ট ঘটনার জন্য ৩০ জুলাই সন্ধ্যায় তার বাসায় গিয়ে শান্তনা দিয়ে বলেছি, আগামী ৪ আগষ্ট যে ফ্লাইট আছে, সেই ফ্লাইটে যেতে তাকে সব ধরণের সহযোগিতা দেয়া হবে। এ ছাড়া ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। রোববার ১লা আগষ্ট তদন্ত করতে আসবেন বিমানের জিএম পদবীর এক কর্মকর্তা।

যখন বিমান বন্দরে ভেতরে এত বড় ঘটনা ঘটে গেলো তখন স্টেশন ব্যবস্থাপক চৌধুরী ওমর হায়াত কোথায় ছিলেন? তিনি যদি ডিউটিতে থাকেন, তাহলে সাথে সাথেই জামিলা চৌধুরীর প্রতি তার স্টাফদের অসদাচরনের ব্যবস্থা নিয়ে তাকে ফ্লাইটে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা তিনি করলেন না কেন? এ প্রশ্ন স্বভাবত:ই মনের মধ্যে জাগে। এই ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর তিনি কেন মহিলাটির বাসায় এসে দু:খ প্রকাশ করে তার লন্ডন ফিরে যাওয়ারও সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন? এটা কি এই রকম নয় যে, চৌধুরী ওমর হায়াত সাহেব আপনার সঙ্গীরা যে ভাবে জামিলা চৌধুরীর প্রতি অসদচারণ ব্যবহার করেন, যা অনেকটা প্রবাসীদের গালে চপেটাঘাত করার মতো, সেই চপেটাঘাত কি এখন জামিলা চৌধুরী আপনাদের দিলেন না?

সিলেট আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে শুধু জামিলা চৌধুরীর ঘটনাই নয়, ইউ টিউবের “রানার টিভি’তে” দেখলাম, গত ৭ই এপ্রিল ৭ ব্রিটিশ বাংলাদেশী পরিবারকে হয়রানী করে ফ্লাইটে উঠতে দেয়া হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সব প্যাসেঞ্জার উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তখন তারা বিমান বন্দর ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চান কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ছিলো, ছোট বাচ্চাদের কত বছর বয়স পর্য্যন্ত করোনার ইংজেকশন না দিলে চলে, জানার জন্য বিমান অফিসে ফোন করেন। তখন বিমান অফিস থেকে নাকি বলা হয়েছে ৭ বছরের নীচে হলে লাগবেনা কিন্তু যখন তারা ফøাইটের দিন বিমান বন্দরে আসেন তখন বাচ্চাদের করোনার ইনজেকশন দেয়ার সার্টিফিকেট চায়। তখন বাচ্চাদের অভিভাবকরা বলেন, আমরা বিমান অফিসে ফোন করে জেনেছি ৭ বছরের নীচে হলে তা লাগেনা, এখন আপনারা বলছেন ৫ বছরের নীচে হলে লাগেনা। আমরা কার কথা বিশ্বাস করবো। তখন পরিবারের অভিভাবকরা বলেন, আমরা ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে চাই, উনাকে ডাকেন। তখন এত চাপের মুখেও ম্যানেজারকে ডাকেনি। এই হচ্ছে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের হালচাল।

আমাদের সিলেট বিমান বন্দরে প্রবাসীদের প্রতি যে ধরণের অসদাচরণ ব্যবহার করা শুরু হয়েছে, তা দেখে বিস্মিত হতে হয়। মনে হচ্ছে যেন, আমরা তাদের হাতে খেলার পুতুল, টাকার জন্য তারা যা ইচ্ছে তা ই করবে। এই অবস্থা চলতে থাকলে প্রবাসীরা দেশে যেতে যেমন ভয় পাবে তেমনি ধীরে ধীরে দেশের প্রতি প্রবাসীদের ভবিষ্যত প্রজন্মের ছেলে মেয়েরাও উৎসাহিত হবেনা। এই অবস্থার অবসান দরকার। এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সহ সারা বিশ্বের প্রবাসীদের সোচ্চার হওয়ার এখনই সময়।

লন্ডন প্রবাসী কমিউনিটি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সহ মিডিয়া জগতে সবার প্রতি আমি বলতে চাই, শুধুমাত্র আলতাব আলী পার্ক আর এখানে সেখানে কয়েকজন বসে মিটিং করেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবেনা। এর জন্য দরকার বৃহত্তর গণসংযোগ, বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে স্মারকলিপি প্রদান, মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরকে দুর্বৃত্তমুক্ত করে প্রবাসীদের আসার যাওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয়ে হয়রানী বন্ধ এবং তাদের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে সম্মিলিত ভাবে আলাপ আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে।

এ ব্যাপারে আমি একটি প্রস্তাব রাখতে চাই। প্রস্তাবটি হচ্ছে, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন এবং কাষ্টমস কর্মকর্তাদের উপর নজরদারী রাখার জন্য (ওয়াচ ডগ) একটি সেল গঠন করা দরকার। নাম নাম দেয়া যেতে পারে “বিমান বন্দরে প্রবাসী যাত্রী নিরাপত্তা সেল ” যাদের কাজ হবে, যে কোন দেশ থেকেই প্রবাসীরা আসুন না কেন তারা বিমান বন্দরে কোন প্রকার হয়রানীর শিকার হচ্ছেন কি না নজর রাখা। এই সেল কিভাবে গঠন করলে কার্য্যকরী হবে তা কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং মিডিয়া সাংবাদিকদের সাথে আলাপ আলোচনা করে সেল গঠনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। এ রকম একটা ব্যবস্থা করতে পারলে আমার মনে হয়, প্রবাসীদের প্রতি হয়রানী কমে আসতে পারে। এটা হলো আমার প্রস্তাব। এর থেকে যদি ভালো কোন প্রস্তাব আমাদের নেতৃবৃন্দের থাকে তাহলে তাও প্রকাশ করতে পারেন এবং সবকিছু যাচাই বাচাই করে একটি স্দ্ধিান্ত আপনারা নিতে পারেন। আমি শুধু এটাই চাই যে, বাংলাদেশে প্রবাসীদের আসা যাওয়ায় যেন কোন প্রকার হয়রানীর শিকার হতে না হয়, তারা যে কোন এলাকারই হোন না কেন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

shares